Wednesday, April 18, 2012

সরকার পতনে ১৮ দলীয় জোট ঘোষণা খালেদার



 অবশেষে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১৮দলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গতকাল এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সমপ্রসারিত এই জোটের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় শরিক ১৭ দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ৩০শে নভেম্বর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। প্রায় এক যুগের মাথায় এই জোট সমপ্রসারিত হলো। এ উপলক্ষে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জোটের প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। চক্রান্ত যতই কুটিল হোক, নির্যাতন যতই বর্বর হোক, জনজোয়ার স্তব্ধ করা যাবে না। সমগ্র জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের জয় হবেই- ইনশাআল্লাহ। সংখ্যায় এবং ক্ষমতার বিবেচনায় এই জোট সবচেয়ে শক্তিশালী বলেও দাবি করেন তিনি। 
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সরকারবিরোধী এই জোট সমপ্রসারণের ঘোষণাপত্র পাঠকালে জোট নেতা খালেদা জিয়া বলেন, সমমনা রাজনৈতিক দল ও আর্থসামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে সকল গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর পক্ষে ঘোষণা দিচ্ছি- একের পর এক জনস্বার্থ বিরোধী, রাষ্ট্রঘাতী, সংবিধান বিরোধী, জনগণের ধর্ম বিশ্বাসবিরোধী, স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, জনগণের ভোটাধিকার নস্যাতের ষড়যন্ত্র এবং সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সকল বৈধতা হারিয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নির্বাচনে চরম কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ আরও অধিক ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। আওয়ামী দুঃশাসনের সর্বগ্রাসী যাঁতাকলে জনগণ আজ নিষ্পেষিত ও বিপর্যস্ত। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন। আওয়ামী লীগের পর্বতসম ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টিকে নিশ্চিত করতেই সংবিধান সংশোধনের নামে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে। দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করতে হবে। সে লক্ষ্যে চারদলীয় জোটের পাশাপাশি আন্দোলনরত সমমনা বিভিন্ন দল ও শ্রেণী-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। আমরা সম্মিলিতভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছি, আজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক নিরাপত্তা বিপন্ন। সরকার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস অনুচ্ছেদটি মুছে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রতিস্থাপন, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা না করা সহ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করায় দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করার লক্ষ্যে আমাদের জাতিগঠনমূলক সকল প্রতিষ্ঠান যথা বিচার বিভাগ, প্রশাসনকাঠামোসমূহকে একে একে চরম দলীয়করণের মাধ্যমে পঙ্গু করে দিয়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরোধী মত ও দলকে দমনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া কলুষিত ও আগামী নির্বাচনে কারচুপি করে বিজয়ী হতে অনুগত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছে। ডিজিটাল কারচুপি করে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে সরকার বিশ্বের নানা দেশে যৌক্তিক ও বাস্তব কারণে বাতিলকৃত ইভিএম দিয়ে ভোট গ্রহণে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করেছে। সংসদ ও জনগণকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে তথাকথিত চুক্তির মাধ্যমে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের নামে ভারতকে করিডোর এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি বলেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মরুকরণসহ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। সকল ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও আলেম সমাজের উপর ক্রমাগত আঘাত হেনে চলেছে। সীমান্তে বিএসএফ’র আক্রমণ, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও নারী-শিশু নির্বিশেষে নিরপরাধ নাগরিকদের প্রতিনিয়ত হত্যা ও অমানবিক নির্যাতন, জমি এবং সম্পদ দখলের প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। শেয়ারবাজারকে আবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তাদের দেশীয় দোসর ও বিদেশী মহাজনরা সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে সাধারণ মধ্যবিত্ত লক্ষ লক্ষ পরিবারের আজীবনের সঞ্চয় লুণ্ঠন করে নিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে এবং বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহনসহ কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদিত সকল সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণের জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার, ভয়-ভীতি ও নির্যাতনের মাধ্যমে একদলীয় ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য সরকার রাজপথ দখলের নামে সরাসরি সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বিরোধীদলীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে বিচারের নামে প্রহসন চলছে এবং বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাবন্দি করা হয়েছে। সরকার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জবাবদিহিতার ধুয়া তুলে গণবিরোধী সমপ্রচার নীতিমালার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা হরণের অপচেষ্টা করছে, সমালোচনাকারী ও সত্য প্রকাশকারী সাংবাদিকদের বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে। জীবন নাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কারা নির্যাতন করা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, দলীয় নেতাকর্মী ও অসৎ ব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্ত্রধারীদের চাঁদাবাজি দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিপন্ন ও দুর্বিষহ করে তুলছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধানসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন ৭ হাজারেরও অধিক হত্যা, দুর্নীতি, নারী নির্যাতনের মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ শত শত সাজাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। সকল শ্রেণী-পেশার জনসাধারণের দাবি- সকল দলের অংশগ্রহণে যথাশিগগির সম্ভব জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে যথার্থই গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় সক্ষম একটি সরকার গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে সংবিধান সংশোধন করে পদত্যাগপূর্বক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সংবিধানের এই মূলনীতির পুনর্বহাল ও বাস্তবায়ন, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সংবিধানের সকল বিধান ও প্রচলিত আইন সংশোধন, সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলির বাস্তবায়ন ও সুরক্ষা, কঠোরহস্তে দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, সর্বস্তরে মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদান, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি দমন এবং সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, আইনের শাসন পুনরুদ্ধার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দ্রুত বিচার আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল, শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়ন ও পরিবেশ পুনরুদ্ধার, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সংঘাতের ও প্রতিহিংসার পথ বিপর্যয়ই ডেকে আনে। তিনি আন্দোলনের বিজয় নিশ্চিত করতে দেশজুড়ে সকল ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও মহানগরে জোটের সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার জন্য জোটের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানান। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, ইসলামী ঐক্য জোটের মহাসচিব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিশের চেয়ারম্যান মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)’র প্রেসিডেন্ট ড. অলি আহম্মদ, বীর বিক্রম, এমপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)’র সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টি এর চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক, ন্যাশনাল পিপলস্‌ পার্টি’র সভাপতি শেখ শওকত হোসেন নিলু, বাংলাদেশ ন্যাপ-এর চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্তজা, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ’র সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান খান, ন্যাপ ভাসানী-এর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান এডভোকেট আবদুল মোবিন, ডেমোক্রেটিক লীগ মহাসচিব মাহবুবুর রহমান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’র মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, বাংলাদেশ পিপলস লীগের চেয়ারম্যান এডভোকেট গরীব নেওয়াজ মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। 

No comments:

Post a Comment